বেঙ্গলনিউজ ডেস্ক, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
২৬ জুন ২০২৩ ০৫:০৪
ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়ায়
গত শনিবার হঠাৎ করে ওয়াগনার বিদ্রোহের ঘটনায় পশ্চিমা নেতৃত্ব ও বিশ্লেষকদের বড় অংশই
এটা ভেবে পুলক অনুভব করেছেন যে, এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট
পুতিনের কর্তৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু বিষয়টি যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির
পুতিনের সাজানো নাটকও হতে পারে, সেদিকে খুব কমই নজর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন,
এটা পুতিনের সাজানো নাটক ছিল, যা রাশিয়ার ইতিহাসেরই অংশ। আবার এমনটাও মনে করা হচ্ছে,
এটি রাশিয়ার দিক থেকে সাজানো ছিল না, বরং ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন নিরাপদ প্রস্থানের
একটি উপায় হিসাবে রক্তপাতহীন বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন।
অন্যদিকে রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্যদল ওয়াগনার বাহিনী যখন বিদ্রোহ করতে ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে
মস্কোর দিকে যাত্রা শুরু করে, তখন সুযোগ বুঝে দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া আক্রমণ
চালিয়েছিল ইউক্রেন। কিন্তু রুশদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে উল্টো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন
হয়েছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। ফলে বিদ্রোহটি রুশদের কোনো ক্ষতি করছে না, এটা প্রাথমিকভাবে
বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে সাজানো বিদ্রোহের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এরপরও এই
ঘটনা ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে—এটাই
এখন বিশ্বজুড়ে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্রোহ
নাটকের পক্ষে যুক্তি
মার্কিন
ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় শনিবারের ‘ওয়াগনার ঘটনার’ সম্ভাব্য
দুটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট রয়েছে। একটি হচ্ছে, ঘটনাটি ছিল একটি থিয়েটারের অংশ, যার সঙ্গে
শীর্ষ মহলের যোগসাজশ জড়িত ছিল এবং সম্ভবত নাটকে কিছু ভুল হয়েছিল। অপর দৃশ্যপট হচ্ছে
এটি একটি সত্যিকারের বিদ্রোহ ছিল, যা ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রুশ সেনাবাহিনী ও
ভারাটে সৈন্যদের তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খলার অগ্ন্যুৎপাত। ঘটনা যাই হোক, আগামী দিনগুলোতে
সম্ভাব্য পরিণতির কী হবে, স্টোই এখন দেখার বিষয়।
বাস্তবতা
হল রাশিয়ার যেকোনো রাজনৈতিক ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
কয়েক দশক ধরে পুতিনের ভুল ‘তথ্যযুদ্ধের’ কারণে এই অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। বলা হয়, রাশিয়ায়
সবকিছুই সম্ভব এবং কিছুই বাস্তব নয়। ওয়াগনার বাহিনীর পতন এবং মস্কোতে তাদের নিরবচ্ছিন্ন
পদযাত্রা, বেলারুশে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের অবসর গ্রহণের চুক্তির মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের
অবসান সব কিছু বিবেচনায় নিলে এটি অসম্ভব বলে মনে হবে যে এটি সাজানো হয়েছিল। মনে রাখতে
হবে যে, রাশিয়ার ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়।
ইতিহাস বলে,
স্ট্যালিনও মিনি-বিদ্রোহের অনুমতি দিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এ ধরনের বিদ্রোহের
মধ্য দিয়ে এটা নির্ধারণ করা যায় যে, কে তার ক্ষমতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। তিনি
কয়েক সপ্তাহের জন্য কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই দপ্তর থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেন এবং এ সময়ে
যারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে তা নির্মমভাবে হত্যা করা
হতো। তবে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন। তিনি অভ্যন্তরীণ শত্রুতাকে জিইয়ে রাখেন এবং
তাতে রেফারি হিসেবে কাজ করেন। তিনি অন্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একপক্ষ ব্যবহার
করেন।
এই তথ্যটি
বিশ্বাস না করলে প্রিগোজিনের ঘটনাটি হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। কারণ, প্রিগোজিন যুদ্ধ
চলা অবস্থায় মাসের পর মাস ধরে কোনো ধরনের শাস্তি ছাড়াই সামরিক নেতৃত্বের সমালোচনা
করে আসছেন। পুতিন স্পষ্টতই এই সমালোচনাকে সহনীয় কিন্তু ব্যবহার উপযোগী হিসেবে দেখছিলেন।
না হলে এতদিনে ওয়াগনার কর্তৃত্ব এবং তথ্য চ্যানেলগুলো নাই হয়ে যেত।
ওয়াশিংটন
পোস্টের মতে, মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা জুনের মাঝামাঝি থেকে প্রিগোজিনের বিদ্রোহের
পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু ক্রেমলিন কেন তাকে থামাতে কিছুই করেনি? প্রিগোজিন
দাবি করেছিলেন যে রাশিয়ান সেনাবাহিনী তার বাহিনীকে আক্রমণ করেছে। সম্প্রতি যেসব ছবি
বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাতে এ ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখা যায়নি। প্রিগোজিন
অদক্ষতা, খারাপ পরিকল্পনা, সৈন্যদের স্বল্প সরবরাহ এবং আরও অনেক কিছুর জন্য জেনারেলদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে
দেখা গেল, প্রায় ২৫ হাজার ভাড়াটে সৈন্য ভারী সরঞ্জাম, ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র এবং
খুব নাটকীয়ভাবে রাশিয়ার ভূখণ্ডের অনেক গভীরে প্রায় মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
এতে স্পষ্ট হয় যে, রুশ বাহিনী দ্বারা ওয়াগনার বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
আরও আশ্চর্যজনক
বিষয় হচ্ছে, ওয়াগনার উত্তরদিকে অগ্রসর হওয়ার সময় কেউ প্রতিরোধ করেনি। তাদের যানবাহনে
ভরা হাইওয়েতে স্যাচুরেশন বোমা বর্ষণ বা এ রকম কিছু আশা করারই কথা ছিল। কিন্তু তা ঘটেনি।
পুতিন বিদ্রোহের নিন্দা জানিয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপর নাটকীয়ভাবে বেলারুশ প্রেসিডেন্টের
কথায় প্রিগোজিন রাজি হয়ে বিদ্রোহ অবসানের ঘোষণা দেন।
প্রশ্ন হচ্ছে,
এটা যদি সাজানো নাটকই হয়, তাহলে হয় তবে উদ্দেশ্য কী ছিল? এর ব্যাখ্যায় দুটি উদাহরণ
দেওয়া যেতে পারে। এর একটি ২০০২ সালে ভেনেজুয়েলায় এবং আরেকটি ২০১৬ সালে তুরস্কে ঘটেছিল।
দুটি ঘটনাই সাময়িক অভ্যুত্থানের মতো মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তা বিদ্যমানরা শাসকদের
আরও শক্তিশালী করেছিল। এখন রাশিয়ার ঘটনায় পুতিনকে আরও শক্তিশালী করবে।
পুতিন সম্ভবত
দেখতে চেয়েছিলেন যে তাকে বহিষ্কারের পক্ষে কাদের সমর্থন থাকতে পারে। অথবা সম্ভবত জনগণের
চোখে সামরিক নেতৃত্বকে অপমান করা, যাতে তিনি তার শাসনকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন এবং ইউক্রেনের
বিপর্যয়ের জন্য তাদের দোষারোপ করতে পারেন।
হতে পারে
সত্যিকারের বিদ্রোহ
যদি এটি
সত্যিকারের বিদ্রোহ হয়ে থাকে, তাহলে এর শেষ পরিণতি কী হতো? প্রিগোজিন যদি নাটকটি করে থাকেন, তাহলে নিশ্চিয়ই
তিনি একা বেলারুশে নির্বাসিত জীবন বেছে নেবেন না। তিনি অবশ্যই বিশ্বাস করেন না যে বেলারুশে
তাকে শান্তিপূর্ণভাবে দিন কাটাতে দেওয়া হবে। তিনি জানেন যে একদিন হয় রুশ গোয়েন্দা
বাহিনী এফএসবি তাকে মেরে ফেলবে, না হয় ইউক্রেনের হিট স্কোয়াডই কাজটি করবে। এটা বাস্তব
যে, বেলারুশ প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো প্রকাশ্যে চিৎকার করা প্রিগোজিনকে রক্ষা করবেন
এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রিগো ক্রেমলিনকে ক্রমাগত অপমান করেন এং লুকাশেঙ্কো তা
সহ্য করে যাবেন, এটা হওয়ার কথা নয়।
এখন দেখার
বিষয় হচ্ছে, প্রিগোর বিদ্রোহ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি এমন হতে পারে যে ওই পরিকল্পনা
ছিল স্বল্পমেয়াদি এবং সম্ভবত তিনি তার চারপাশের অক্ষমতা ও ভয়াবহতায় সত্যিই ক্লান্ত
হয়ে পড়েছিলেন এবং বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। সম্ভবত এটি তার ইচ্ছার চেয়ে
অনেক বড় কিছুতে পরিণত হয়েছিল। এখন সম্ভবত বেলারুশে হত্যাকারীরা তাকে ধরার আগেই তিনি
নিজেকে মদ্যপান করে শেষ করে দিতে পারেন।
এখন কি
হবে?
রাজনৈতিক
বিশ্লেষণধর্মী মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ওয়ারলর্ড ইয়েভগেনি
প্রিগোজিনের স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহ মূলত ক্ষমতার ওপর পুতিনের দুর্বল প্রভাব এবং রাশিয়ার
নিজস্ব সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট
হলো যে পুতিনের শাসন অপরাজেয় নয়। পুতিন ওই দিন সকালে যে ভাষণ দেন, তাতে প্রিগোজিনের
হুমকিকে তিনি কতটা গুরুত্বসহকারে দেখছেন সেটাও বোঝা গেছে।
এই অবস্থায়
পুতিনের উচিত ১৯৯১ সালের আগস্টে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের বিরুদ্ধে
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দিকে নজর দেওয়া। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থীরা গর্বাচেভের
সংস্কার প্রচেষ্টায় ক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরেুদ্ধ বিদ্রোহ করেছিল। দেখা যাচ্ছে প্রিগোজিনের
বিদ্রোহের মতো ১৯৯১ সালের আগস্ট অভ্যুত্থানও স্বল্পস্থায়ী ছিল। কিন্তু এর পরিণতি সোভিয়েত
ইউনিয়নের জন্য বিপর্যয়কর ছিল। এর ফলে কমিউনিস্ট শাসনের প্রতি আস্থা হ্রাস পেয়েছিল
এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর টিকেনি।
এখন প্রশ্ন
হচ্ছে, ভাড়াটে সৈন্যরা কোথায় যাবে। প্রিগোজিন পথ থেকে সরে যাওয়ায় এখন ধারণা করা
হচ্ছে, তাদের ২৫ হাজার ভাড়াটে সৈন্য হয় ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাবে অথবা রাশিয়ার
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করবে। কারণ কয়েক মাস ধরেই রাশিয়া ভাড়াটে
সেনাদের নিয়মিত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল, যার বিরোধিতা করে আসছিলেন প্রিগোজিন।
অন্য দিকে এই বিদ্রোহ ইউক্রেনকে আক্রমণে উৎসাহিত করবেন। কারণ, শনিবারের অস্বাভাবিক ঘটনাটি ইউক্রেনের
বাহিনীকে মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত কিয়েভ সেটাই মনে করছে। যেমনটা ইউক্রেনের সংসদ
সদস্য রুডিক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিশ্ব যা দেখেছে তা হলো পুতিন সর্বশক্তিমান
নন। তিনি অপরাজেয় নন।’
তবে ইরানের
সংবাদমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনালের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতি অতিক্রম
করা রাশিয়ার জন্য কঠিন কিছু নয়। ইরানের রক্ষণশীল এমপি ও সাবেক আইআরজিসি জেনারেল এবং
জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশবিষয়ক পার্লামেন্টারি কমিটির সদস্য ইসমাইল কাওসারী মনে করেন,
এই ঘটনা চ্যালেঞ্জের হলেও পুতিনকে দুর্বল করবে না। তিনি ‘দিবদান ইরান’ ওয়েবসাইটকে বলেন,
যা ঘটেছে তা ওয়াগনার বাহিনীতে পশ্চিমা অনুপ্রবেশের কারণে ঘটেছে। তবে শেষ পর্যন্ত এটা
নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ধরনের পরিস্থিতি অতিক্রম করার
জন্য রাশিয়ার যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে।
এবি/এইচআই