রিপন কর্মকার, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
২৩ জুন ২০২২ ০৫:৪১
ছবি : উইকিপিডিয়া
বাংলাদেশের
ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আজ (২৩ জুন) ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে রাজধানীর পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’-এ প্রতিষ্ঠিত
হয় একটি রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ পরবর্তী সময়ে যা হয়ে যায়
‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
১৯৪৭ সালে
পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যেসব প্রগতিশীল নেতা ছিলেন, তাদের
নানাভাবে কোনঠাসা করে রাখা হয়। আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে একটি বই লিখেছেন লেখক ও
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ। সেখানে তিনি বলছেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার
পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন।
সোহরাওয়ার্দী-আবুল
হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যেসব প্রগতিশীল কিংবা উদারপন্থী
নেতা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০
নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল
গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত
হন।
সেই চিন্তার
সঙ্গে যুক্ত হয় মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হকও। নতুন দল গঠনের লক্ষ্যে তারা একটি সভা
ডাকেন। সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন
ইয়ার মোহাম্মদ খান। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সম্মেলন করার জন্য কোথাও কোনো
অডিটোরিয়ামে অনুমতি দিচ্ছিল না। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কারাগারে। সে সময়
কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে
রোজ গার্ডেন সম্পর্কে লিখেন, ‘কোথায়ও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন
সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’
রোজ গার্ডেনে
২৩ জুন বিকালে প্রায় ৩০০ লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব
পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা
হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকেই দলে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তখন সম্মেলনে
উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের
চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর
রশীদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা
শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।
পরে ১৯৫৫
সালে এর নাম পরিবর্তন করে হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার
পর নাম হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।’
ইতিহাসবিদ,
লেখক ও লোক সাহিত্যিক শামসুজ্জামান খান এই দলকে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, পূর্ব বাংলার
জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে অবজ্ঞায়, অবহেলায় ও ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ-পীড়ন-দমন
ও দাবিয়ে রাখার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে
ওঠা বিপুল জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দল হলো আওয়ামী লীগ।
‘অসমাপ্ত
আত্মজীবনী’তে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কারণ এবং সাংগঠনিক তৎপরতা ও নিজের সম্পৃক্ততা নিয়ে
বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই।’
বঙ্গবন্ধু
লিখেছেন, ‘ আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন
গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া
উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের
কোনো কর্মপন্থাও নাই।’
বঙ্গবন্ধু
আরও লেখেন, “আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির
আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট
জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন
আমাকে চুপি চুপি বলে, ‘মুজিব ভাই, পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার
সাথে মুক্তি পাচ্ছি, একটা মালা তো পাব।’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, আর কেউ না দিলে তোমাকে
আমি মালা পরিয়ে দিতাম। জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে
দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে
তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ ধ্বনি
উঠল। জেলগেটে এই প্রথম আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ হলো। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাকে
অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়। হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে
ধরলেন এবং বললেন, চল, এবার শুরু করা যাক।”
রোজ গার্ডেন
সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে অবস্থিত রোজ গার্ডেন হচ্ছে
একটি ঐতিহাসিক বাগানবাড়ি। বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, ১৯৩০ সালের দিকে ঋষিকেশ দাস নামের
এক ব্যবসায়ী ২২ বিঘা জমির ওপর এই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করেন। ভবনের বাগানে গোলাপের
প্রাচুর্য থাকায় বাড়ির নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’।
অভিনব নির্মাণশৈলীর
কারণে এটি হয়ে ওঠে ঢাকার অন্যতম মনোরম ভবন। ঋষিকেশ দাস ১৯৩৬ সালের দিকে ব্যবসায়ী খান
বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। বাড়ির নাম রাখা হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’।
কিন্তু ‘রোজ গার্ডেন’ নামটি মানুষের মুখে মুখে রয়েই যায়।
১৯৮৯ সালে
বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রাসাদটিকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
সরকারি ক্রয়
আইন’ অনুযায়ী ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিনিময়ে বর্তমান মালিকের কাছ থেকে এ স্থাপনা ক্রয়
করেছে সরকার।
রোজ গার্ডেন
ক্রয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পুরান ঢাকার ইতিহাস তুলে ধরতে ঐতিহাসিক
রোজ গার্ডেনকে জাদুঘরে পরিণত করা হবে। রোজ গার্ডেনের একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। কেননা
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে।’
ঐতিহাসিক
গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান এটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আরকে/এসএল/কেএ