কনটেন্ট ক্রিয়েটর, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
০৬ মে ২০২২ ০৩:২০
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার হ্রদ বগালেক। ছবি : বেঙ্গলনিউজ২৪
দেশের অভ্যন্তরে
বেড়াতে গিয়ে শুধু হামলাই নয়, নানা রকমের হেনস্তারও শিকার হন বাংলাদেশের পর্যটকরা। অতিরিক্ত
হোটেল ভাড়া, খাবারের বাড়তি দাম, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটূক্তি ও যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ
নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ও অব্যবস্থাপনার বিড়ম্বনা তো
আছেই। পর্যটকরা বলছেন, ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরও এসব ভোগান্তির কারণে দেশের পর্যটন
খাত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার
(৫ এপ্রিল) সিলেটের জাফলংয়ে পর্যটকদের ওপর স্বেচ্ছাসেবকদের হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে
দেশের পর্যটনের দৈন্যদশার বিষয়টি আবারো আলোচনায় আসে। ওই ঘটনায় পাঁচ হামলাকারীকে আটক
করে পুলিশ।
জাফলংয়ের ঘটনায় ফেসবুকে নিন্দা জানিয়েছেন পর্যটকরা।
ভ্রমণবিষয়ক ফেসবুক পেইজ ‘ট্রাভেলার্স অব গ্রেটার সিলেট’-এ জুনোয়েদুর রহমান নামের এক
পর্যটক লিখেছেন,‘সিলেটের পর্যটন শিল্পের
জন্য অশনিসংকেত! সারা জীবন জাফলং গেলাম কখনো টিকিট লাগল না। আর আজ টিকেট কেনাকে
কেন্দ্র করে স্বেচ্ছাসেবকরা পর্যটকদের উপর হামলা করেছে, নারীদের হেনস্থা করা
হয়েছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে পর্যটকরা সিলেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করব।’
অমিত কুমার দে নামের এক
পর্যটক লিখেছেন, ‘আমি গতকাল চট্টগ্রাম থেকে জাফলং গিয়েছিলাম। হাজার হাজার লোকাল
ছেলেপেলে। সবগুলো লম্পট, লোলুপ দৃষ্টি। বউ-বাচ্চা নিয়ে যাওয়া খুব বিপজ্জনক। সিলেটে
সব জায়গায় গেছি, কিন্তু এখানেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছি। প্রশাসন বলে এখানে কিছু
নেই। তাই নিজ দায়িত্বে সাবধান থাকুন।’
বাংলাদেশের
পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীদের। এ বিষয়ে পর্যটক
এলিজা বিনতে এলাহী বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘বেশির ভাগ পর্যটনকেন্দ্রে
পরিচ্ছন্ন ‘ওয়াশরুম’ (শৌচাগার) নেই। নারীরা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
তথ্যের অপ্রতুলতা তো আছেই। পর্যাপ্ত যানবাহন ও থাকার জায়গা নেই। অনেক জায়গায় গাইড
করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, ‘অনেক জায়গায় গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের
পোশাক পরা যায় না; সামাজিকভাবে অপদস্ত হতে হয়।’
ভোগান্তির বিষয়ে
মোর্শেদ হোসাইন নামের এক পর্যটকের সঙ্গেও কথা হয় বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোরের। তিনি
বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মূল পর্যটনকেন্দ্রে যাওয়া-আসার রাস্তা এতটাই
সরু যে পুরো ভ্রমণই অনেক সময় মাটি হয়ে যায়। পেশাদার সেবা পাওয়া যায় না। নিরাপত্তা
নিয়েও ভাবতে হয়। সুযোগ বুঝে সব ধরনের সেবা ও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
মোর্শেদ বলেন, ‘বেশির ভাগ পর্যটনকেন্দ্রে হোম স্টে কিংবা কম খরচে থাকার সুবিধা
নেই।’
বাংলাদেশের পর্যটনখাতের
প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরতে গিয়ে পর্যটক শায়লা বিথী বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘নিরাপত্তার
কারণে বেশির ভাগ জায়গায় নারীরা একা ভ্রমণ করতে পারেন না। চেকিং পোস্টে অবান্তর
প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।’
হামলার
ঘটনা নতুন নয়
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি
বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে হামলা ও শ্লীলতাহানির শিকার হন ১১ পর্যটন। পর্যটনকেন্দ্র নীলাচলের
অভ্যন্তরে নীলাম্বরী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের সামনে এ ঘটনা ঘটে। পরে বান্দরবান
সদর থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। ওই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা-রাঙামাটি সড়কে পর্যটকবাহী
চাঁন্দের গাড়িতে গুলিবর্ষণের ঘটনায় চার তরুণী আহত হয়। ওই গাড়িতে প্রায় ১৯
তরুণ-তরুণী ছিলেন। তারা রুমার বগা লেক ঘুরে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে দুর্বৃত্তরা তাদের
গাড়িতে গুলি চালায়।
ওই ঘটনার দুদিন আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হামলার শিকার হন ৯
পর্যটক। বাড়বকুণ্ড নড়ালিয়া এলাকার সোনারগাঁও পেট্রোল পাম্প এলাকার ওই ঘটনায় পুলিশ
কয়েকজনকে আটক করে।
২০২০
সালের ফেব্রুয়ারিতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সময় এক বিদেশি পর্যটককে হয়রানি ও
গালিগালাজ করেন এক যুবক। ওই যুবকের নাম মো.সালমান। ঘটনার পর পুলিশ তাকে আটক করে।
২০১৯
সালের মার্চে ময়মনসিংহ থেকে সিলেটে বেড়াতে যাওয়া এক দম্পতিকে হেনস্তা ও তাদের কাছ
থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগে ওঠে এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। পরে ওবায়দুর রহমান নামের
ওই এএসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ায়
ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এক পর্যটক নিহত হন। নিহত ব্যক্তির নাম আবু তাহের (২০)। তিনি
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলগান্ধী গ্রামের শফি উল্লাহর ছেলে।
২০১৯ সালের ৯ জুন কুয়াকাটায়
চলন্ত বাসে হামলার শিকার হন কয়েক পর্যটক। বাসের বাসের চালক, সুপারভাইজার ও হেল্পারসহ
পরিবহন শ্রমিকরা তাদের মারধর করেন।
২০১৪ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে থেকে ফেরার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন এক বিদেশি পর্যটক।
অবশ্য পর্যটন শহরগুলোতে চুরি-ছিনতাই
কমেনি; বরং বেড়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারে হঠাৎ ছিনতাই ও চুরি বেড়ে গেছে। এই অবস্থায়
শহরবাসী ও পর্যটন উদ্যোক্তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজার শহরেই
অন্তত ২০টি ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ৬ মার্চ পর্যটন পর্যটকদের নিরাপত্তা চেয়ে জেলা
প্রশাসকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয় হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস
অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
পর্যটকবান্ধব ১০ দেশ
সম্প্রতি
বিশ্বের পর্যটকবান্ধব শীর্ষ ১০ দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে জেনেভাভিত্তিক সংস্থা
‘ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম’ (ডাব্লিউইএফ)। পর্যটকদের নিরাপত্তা, আকর্ষণীয় স্থান, যাতায়াতের সুব্যবস্থা ইত্যাদি মানদণ্ডের ভিত্তিতে তালিকাটি করা হয়েছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের দেশ স্পেন।
২০১৫ সাল থেকে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে দেশটি। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ফ্রান্স
ও জার্মানি। এই তিনটি দেশকে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য বলে অভিহিত
করা হয়েছে। তালিকায় এরপরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের নাম। শীর্ষ দশে রয়েছে যুক্তরাজ্য,
অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডও।
এএল/ইউএইচ/জেডএস