নিজস্ব প্রতিবেদক, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
১৩ নভেম্বর ২০২৪ ০১:২৭
ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের আতঙ্ক কাটেনি এখনো। যাদের হাতে পরিবারের সদস্য খুন হয়েছে তারাই এখন ক্ষমতায় থাকায় সাহস পাচ্ছেন না মামলা করার। অনেকে বিচার পাবার আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। নিহত পুলিশ সদস্যদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।
গত এক সপ্তাহে নিহত পুলিশদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে
কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনকারীদের ভয়ে এখনো অনেকের পরিবার এলাকায় যাচ্ছেন না। তারা
এক দিকে স্বজন হারানোর শোক, অন্যদিকে ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত
হয়েছেন। তবে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের অনেকের মতে, নিহতের সংখ্যা আরো বেশি। এসব হত্যার
ঘটনায় মামলা এবং কারা আসামি তা নিয়ে লুকোচুরি করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। মামলার বিষয়ে
পুলিশ সদরদপ্তরের মিডিয়া শাখা থেকে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)
পক্ষ থেকেও মামলার বিষয়ে তথ্য জানা যায়নি।
পুলিশ হত্যার ঘটনায় মামলার বিষয়ে জানতে ডিএমপি সদরদপ্তরের সংশ্লিষ্ট
বিভাগে যোগাযোগ করলে বলা হয়, ডিএমপি’র মিডিয়া শাখা থেকে এ বিষয়ে জেনে নিতে। তবে ডিএমপি’র
মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিশেনস বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান
গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখনো কোনো মামলা হয়েছে সুনির্দিস্ট এমন তথ্য আমার কাছে নেই।’
সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জেনে দিতে বললে তিনি বলেন, ‘এধরনের মামলার
বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে। তদন্তে শেষে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসব।’
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হামলায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের
মধ্যে ১৪ জন ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তারা হলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের ইন্সপেক্টর
মো. রাশেদুল ইসলাম, এসআই শ্রী সুজন চন্দ্র দে, এসআই খগেন্দ্র চন্দ্র সরকার, এএসআই সঞ্জয়
কুমার দাস, এএসআই ফিরোজ হোসেন, নায়েক মো. গিয়াস উদ্দিন, কনস্টেবল মো. আব্দুল মজিদ,
কনস্টেবল মো. রেজাউল করিম, কনস্টেবল মো. মাহফুজুর রহমান, কনস্টেবল মো. শাহিদুল আলম,
কনস্টেবল মো. আবু হাসনাত রনি, কনস্টেবল মীর মোনতাজ আলী, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়, কনস্টেল
মো. খলিলুর রহমান।
দেশের অন্যান্য থানা এলাকায় নিহত হন, কনস্টবল সুমন কুমার ঘরামী, কনস্টবল মোহাম্মদ আব্দুল মালেক, এসআই মো. সোহেল রানা, এএসআই রাজু আহম্মেদ, এসআই রেজাউল করিম, কনস্টবল মাইনুদ্দিন লিটন, এসআই মো. মামুনুর রশীদ সরকার, এসআই মো. বাছির উদ্দিন, কনস্টবল মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ইন্সপেক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক, এসআই মো. রইস উদ্দিন খাঁন, এসআই মোঃ তহছেনুজ্জামান, এসআই প্রনবেশ কুমার বিশ্বাস, এসআই মো. নাজমুল হোসাইন, এসআই আনিসুর রহমান মোল্যা, এএমআই মো. ওবায়দুর রহমান, কনস্টবল মো. আব্দুস সালেক, কনস্টবল মো. হাফিজুল ইসলাম, কনস্টবল মো. রবিউল আলম শাহ্, কনস্টবল মো. হুমায়ুন কবির, কনস্টবল মো. আরিফুল আযম, কনস্টবল মো. রিয়াজুল ইসলাম, কনস্টবল মো. শাহিন উদ্দিন, কনস্টেবল মো. হানিফ আলী, এসআই সন্তোষ চৌধুরী, এএসআই মো. রফিকুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর মো. মাসুদ পারভেজ ভ‚ঁইয়া, এএসআই মো. মোক্তাদির, কনস্টবল মো. এরশাদ আলী, এটিএসআই আলী হোসেন চৌধুরী। গত ২০ জুলাই থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে এসব পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে আন্দোলনকারীরা।
৪৪ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিহত হন গত ৫ আগস্ট। এদিন ২৫
পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। আগের দিন ৪ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে
হত্যা করে। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই দু'জন, ২১ জুলাই একজন ও ১৪ আগস্ট এক
পুলিশ সদস্য মারা যান।
নিহতের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (২১ জন) নিহত হয়েছেন কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্য। নিহতদের তালিকায় ১২ জন উপ-পরিদর্শক, ৭ জন সহকারী উপপরিদর্শক, ৩ জন পরিদর্শক ও একজন নায়েক রয়েছেন। একক থানা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৫ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায়।
এখনো আতঙ্কের মধ্যে দিন পাড় করছেন নিহত পুলিশ পরিবারের সদস্যরা।
সহকর্মীদের হত্যার বিচারে গুরুত্ব না দেওয়ায় বর্তমান পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের
প্রতি ক্ষুব্ধ নিহতদের স্বজনরা।
গত ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় হত্যার শিকার হন
ডিএমপির ডিবি উত্তরা বিভাগের পরিদর্শক মো. রাশেদুল ইসলাম। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়।
রাশেদুল ইসলামের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে রাশেদুল আমাকে
ফোন করে ৩০ সেকেন্ড কথা বলে। তখন বলেছে, আমার দুইটা পা ভেঙ্গে গেছে। আমাকে উত্তরা পূর্ব
থানার পেছনে খোজ কইরো।
সুলতানা রাজিয়া জানান, ফোনে কথা বলার পর রাশেদুলকে উদ্ধারে তিনি
রাজধানীর কল্যানপূর এলাকার বাসা থেকে অনেক কষ্টে উত্তরা পূর্ব থানায় যান। তবে স্বামীকে
উদ্ধার করতে পারেন নি। সুলতানা রাজিয়া বলেন, ‘আমি রাত ১১ টায় থানাতে পৌছাই। থানার পেছনের
দেয়ালের বাইরে ছিলাম আমি। দেয়ালের অপর প্রান্তে সে ছিল। তাকে বাঁচাতে পারি নাই। রাত ১২টার দিকে রাশেদুলকে
পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমাকেও আটকিয়েছিল, মেরেই ফেলত। কিন্তু বাড়ির লোকেরা আমাকে টেনে
নিয়ে আসছে।’
সুলতানা রাজিয়া আরও বলেন, ‘আমি কোনো মামলা করিনি। আমি এখন কোনো
ঝামেলার মধ্যে যেতে চাই না। সরকার যদি করে করবে, আমার একার পক্ষে মামলা লড়া সম্ভব না।
আমার চার ও আট বছরের দুটো ছোট মেয়ে আছে। আমি তো এমনিতেই একা। তার উপর এসব মামলা কে
দেখবে। পুলিশে চাকরির জন্য কমিশনার স্যারের কাছে আবেদন করেছি, সিভি দিয়েছি। এখনো কোনো
নিশ্চয়তা পাইনি। দুটো বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, কী করব বুঝতে পারছি না। এখনো বাড়িতে যেতে
পারি নাই।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় মারা যান কনস্টেবল মো. আব্দুস সালেক।
তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তার। পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস
ছিলেন আব্দুস সালেক।
তার স্ত্রী হোসনে আরা খাতুন বলেন, ৪ আগস্ট দুপুর ১২টা ৪৩ মিনিটে
তার (আব্দুস সালেক) সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। এক মিনিট ১০ সেকেন্ড কথা বলে। তখন আহত অবস্থায়
থানাতেই ছিল। ফোন করে আমাকে বলেছিল, যদি বেচে থাকি তাহলে দেখা হবে। আর ওর মাকে বলেছিল,
আমি হাতে আঘাত পেয়েছি। আমার জন্য দোয়া কইরো মা। এরপর থেকে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা
করেও যোগাযোগ করতে পারি নাই। বিকেল ৪টার দিকে টিভিতে নিউজ দেখলাম অনেকগুলো লোক মারা
গেছে। তিনদিন পর লাশ পেয়েছিলাম। আমরা কোনো মামলা করি নাই। বিচার আল্লাহর কাছে চাই।
একই থানায় মারা যান কনস্টেবল মো. হুমায়ুন কবির। তার বাড়ি পাবনায়।
১৩ ও ৮ বছরের দুই ছেলে রয়েছে হুমায়নের। তার স্ত্রী জান্নাতুল নাইমা বলেন, ৪ আগস্ট সকালে
ফোনে কথা হয়। কথা বলা অবস্থায় বলে মিছিল আসতেছে ফোন রাখো। পরে আর কোনো কথা হয়নি। আহত
অবস্থায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালের আইসিইউতে ছিল। একদিন পরে মারা যায়।
জান্নাতুল নাইমা বলেন, আমি কোনো মামলা করি নাই। কি করব আল্লাহ
জানে। বাড়িতেও যাই নাই। আমার স্বামী যেখানে রেখে গেছিল সেখানেই আছি।
এনায়েতপুর থানায় আরও মারা যান কনস্টেবল হানিফ আলী। তার স্ত্রী
সুমাইয়া খাতুন বলেন, আমরা কোনো মামলা করি নাই। যা করার থানা থেকেই করেছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ডিএমপি’র উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়
পাঁচ জন পুলিশ সদস্য মারা যান। এসব মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে
উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুহিবুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন,
‘আমি থানায় আসার পর একটি মামলা হয়েছে।’ এর বেশি কোনো তথ্য তিনি জানাতে চাননি।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী যাত্রাবাড়ি থানা এলাকায় আটজনকে হত্যা করে
আন্দোলনকারীরা। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডিএমপির ওয়ারি বিভাগের
উপ কমিশনার (ডিসি) মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘একটি মামলা হয়েছে। অন্যগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে।’
/এসবি