নিজস্ব প্রতিবেদক

বেঙ্গল নিউজ টোয়েন্টিফোর


১৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৫



পরিবহন চাঁদাবাজি এখন বিএনপির কব্জায়

নিজস্ব প্রতিবেদক, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর

১৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৫

পরিবহন চাঁদাবাজি এখন বিএনপির কব্জায়

ছবি: বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর

দেশের পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি কব্জায় নিয়েছে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তারা পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দখল করে এ খাতে বড় ধরনের চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। পরিবহনের কোন খাতে কতো টাকা চাঁদা নেওয়া হবে তার হারও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজির পথ তৈরি করা হয়েছে। বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সারাদেশে পণ্য ও গণপরিবহন থেকে মূলত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি করা হয়। তিন ভাবে এখন চাঁদাবাজি চলছে- দৈনিক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের চাঁদা, বাস ও মিনিবাসের নির্দিষ্ট পথের চাঁদা ও কম্পানিভিত্তিক চাঁদা। আদায় করা চাঁদা এসব সংগঠনের নেতাদের হাত ধরেই ভাগাভাগি হয়।

এ বছর প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা মতে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা সম্পৃক্ত।

মুহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় তিন মাস পর সম্প্রতি পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির বিষয়ে অনুসন্ধান করে বেঙ্গল নিউজ টোয়েন্টিফোর। চাঁদা তোলার সাম্প্রতিক একটি নির্দেশিকা বেঙ্গলনিউজের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে নির্দেশ দিয়েছে। এতে প্রতিদিন ঢাকা মহানগরের আওতাভুক্ত প্রতিটি বাস ও ট্রাকের ক্ষেত্রে ১১০ টাকা, ঢাকা মহানগরের কোম্পানির নামে পরিচালিত বাসের ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, ঢাকার বাইরে অন্য জেলার ক্ষেত্রে প্রতিটি বাস ও ট্রাকে ৭০ টাকা, উপজেলার শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য ২০ টাকা, প্রাইম মুভারের চাঁদা ২০০ টাকা করে দিতে বলা হয়েছে।

এই চাঁদার ভাগ কারা কতো পাবে তা বলে দেওয়া আছে সেই নির্দেশিকায়। যেমন- ঢাকা মহানগরীর একটি বাস থেকে আদায় করা ১১০ টাকা চাঁদার মধ্যে টার্মিনাল মালিক সমিতি পাবে ৩০ টাকা, সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ইউনিয়ন নিবে ৩০ টাকা, ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ২০ টাকা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকা, কমিউনিটি পুলিশ ১০ টাকা ও টার্মিনাল কমিটি পাবে ১০ টাকা।

পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্প্রতি টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ পান দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চর্চার পরিবর্তন হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। কিন্তু আবার চাঁদাবাজি শুরু হওয়ায় আমি অবাক হচ্ছি না। নির্বাচনের আগেই এই অবস্থা! আসলে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর স্বদিচ্ছা না থাকলে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি কখনই বন্ধ করা সম্ভব হবে না। 

মালিক সমিতির চাঁদাবাজির নেতৃত্বে বিএনপির সাইফুল

গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয় কয়েকদিন তালাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৩ আগস্ট তালা খুলে কার্যালয় দখলে নেয় কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া। এরপর অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করে তিনি সভাপতি হয়ে যান।

এর আগে বিএনপি যখন সরকারে ছিল তখন সাইফুল ইসলাম দুই বার এই সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন তার সভাপতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি এবার প্রকাশ্যে কমিটিতে নেই। তবে সমিতির নীতিনির্ধারণী বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে ভূমিকা রাখছেন বলে জানা গেছে।

পরিবহন মালিকদের দুই ধরণের সংগঠন আছে। একটি সমিতির আওয়াত পরিচালিত হয়, অন্যটা টার্মিনাল কেন্দ্রিক। টার্মিনাল ঘিরে গড়ে ওঠা সংগঠন বাংলাদেশে বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সংগঠনের আওতায় দূরপাল্লায় চলা উন্নত বাসের সংখ্যা বেশি। গাবতলী থেকে পরিচালিত হওয়ায় সেখানে এই সংগঠনের আধিপত্য বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালগুলোর পুরনো কমিটির কার্যক্রম নেই। সেগুলোও দখল হয়েছে। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ। কিন্তু বর্তমানে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমিনবাজার ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও হানিফ পরিবহনের মালিক কফিল উদ্দিন।

মহাখালী টার্মিনাল সূত্র বলছে, এই টার্মিনাল থেকে দিনে প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা উঠে। এখন এই চাঁদাবাজির নেতৃত্বে দিচ্ছেন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল আলম ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরব। ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনালসহ ঢাকার অন্যান্য জায়গার ট্রাক টার্মিনালগুলোও নীরব নিয়ন্ত্রণ করছেন। 

জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, 'বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি হতে পারে। কিন্তু আমরা কোনো চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছি না। চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। তাঁরা সব সময় সুবিধা নেওয়ার সুযোগ খোঁজে। আগে যারা চাঁদাবাজি করতো তাদের কিছু লোক হয়তো বিদেশে চলে গেছে, পালিয়ে আছে। বাকিরা তো এখনও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। উল্টো আমরা চাঁদাবাজি বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছি।'

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ্‌। ঢাকা মহামগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনায়েত আগস্টের পট পরিবর্তনের সময় পর্যন্ত সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময়ে সমিতির সভাপতি ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গা। তাদের হাতেই এ খাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল।

শ্রমিকদের নেতৃত্বে আসছেন বিএনপির শিমুল

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো। দেশে ২৪৯টি নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। সবগুলোকে জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ছাতার নিচে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই সংগঠনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বাম ঘরনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে পরিচালিত হয়।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান গ্রেফতার হয়েছে। বর্তমান কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুর রহিম বখশ। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এখন পলাতক। তিনি বাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এখন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির খান। বর্তমান কমিটির দুই সহসভাপতির মধ্যে একজন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। অন্যজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কাজী মোতাহার হোসেন।

একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হাল ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে শিমুল বিশ্বাস গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, শ্রমিক সংগঠনের চাঁদাবাজির বোতল ও মধু একই আছে শুধু বোতলের মোড়ক বদলেছে। আগে এ টিম চাঁদাবাজি করতো এখন বি টিম করে। তা ছাড়া আর কিছুই পরিবর্তন হয়নি। চাঁদার টাকার ভাগ আগের মতো সবাই পাচ্ছে। 

এনায়েতের 'এনা' এখন সাইফুলের 'ইউনাইটেড'

বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনা পরিবহনের প্রায় ৪০০ বাস চলাচল করতো। এনার ব্যানারে একাধিক ব্যক্তির মালিকানাধীন বাস থাকলেও বেশির ভাগই ছিল আওয়ামী লীগ নেতা এনায়েত উল্লাহ্‌র। সরকার পতনের পর এনা পরিবহনের বাস এই পথে তেমন চলতে দেখা যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এনা এখন ইউনাইটেড নামে চলাচল করছে। এই ইউনাইটেড ব্যানারের বাসগুলো পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি ও বিএনপি নেতা সাইফুল আলম।

জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ্‌ বলেন, আমার বাস এখন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমি কোনো দিন কারো ব্যবসার ক্ষতি করিনি। কোনো দিন কারো বাস বন্ধ করিনি। এনা পরিবহনের সব বাস দখল করা হয়েছে।

তবে এনায়েতের অভিযোগ অস্বীকার করেন সাইফুল আলম। তিনি বলেন, একটা কোম্পানির বাস চলাচলের ক্ষেত্রে দুই প্রান্তের ব্যবসায়ীরা এতে যুক্ত থাকেন। কিন্তু এতোদিন ময়মনসিংহের ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হয়েছেন। তাই তাঁরা ইউনাইটেড নাম দিয়ে বাস চালাচ্ছে। ময়মনসিংহ ছাড়া অন্য সব রুটেই এনার কিছু বাস স্বাভাবিকভাবেই চলছে।

/এসবি