প্রকৌশলী এম. হোসেন
বেঙ্গল নিউজ টোয়েন্টিফোর
২৭ জুলাই ২০২৫ ১১:১৪
প্রকৌশলী এম. হোসেন, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
২৭ জুলাই ২০২৫ ১১:১৪
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বই “A World of Three Zeros”-এ "থ্রি জিরো থিওরি" উপস্থাপন করেন । ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে গঠিত এই তত্ত্বটি দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে । এই তত্ত্বটি জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDGs) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs)-এর মূল নীতিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত , কারণ এটি বৈশ্বিক উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য একটি দৃঢ় ও সমন্বিত কাঠামো তৈরি করে । 'থ্রি জিরো থিওরি' ("Zero Poverty, Zero Unemployment, Zero Net Carbon Emissions" দ্বারা চিহ্নিত) MDG ও SDG-এর অন্তর্ভুক্ত নীতিগুলোর মধ্যেই নিহিত । এখানে দারিদ্র্য নিবারণ, সবার জন্য কর্মসংস্থান এবং জলবায়ু সুরক্ষা—এই তিন স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে একটি টেকসই ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয় ।
২০০০ সালে জাতিসংঘে ঘোষিত মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্য (MDGs) ছিল আটটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন লক্ষ্য, যা ২০১৫ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সংকট কমানোর ওপর জোর দেয় । এর ভিত্তিতে, ২০১৬ সাল থেকে চালু করা হয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) , যেখানে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বর্তমান বিশ্বের প্রাধান্যপ্রাপ্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ১৭টি যুগোপযোগী উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় । ২০১৭ সালে প্রকাশিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের “থ্রি জিরো থিওরি” অর্থাৎ Zero Poverty, Zero Unemployment, Zero Net Carbon Emissions—এসডিজির ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে খাপ খায় , কারণ এর মূল ধারণাগুলোই জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত SDG কাঠামো থেকে নেওয়া এবং তার সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে, বাংলাদেশ সবার জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং পরিবেশগত টেকসইতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে । এই উন্নয়নগুলো দারিদ্র্য প্রশমন কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে । ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আটটি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (MDGs)–এর পাঁচটি অর্জন করে । বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সেপ্টেম্বর ২০১৪–এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিট ভর্তি হার ৯৮.৫% ছিল । শিশু মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে । ১৯৯০ সালে প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে ১৪৬ জন শিশু মৃত্যুবরণ করত, যা ২০২১ সালে কমে ২৭ জনে নেমে এসেছে অর্থাৎ ৮১.৫% হ্রাস পেয়েছে । এই সাফল্যের জন্য ২০১০ সালে জাতিসংঘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এমডিজি সম্মাননা প্রদান করে । এই উন্নয়নগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ ।
অধিকন্তু, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার দিনে দিনে কমে এসেছে । ১৯৯০ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৭% (জাতীয় দারিদ্র্যরেখার হিসেবে), যা ২০১০ সালে ৩১.৫%-এ নেমে আসে । এরপর ২০১৬ সালে তা কমে ২৪.৩% এবং ২০১৯ সালে আরও হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২০.৫%–এ । একইভাবে, শিশু পুষ্টিতেও উদ্বেগজনক উন্নতি দেখা গেছে । ১৯৯৬–৯৭ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বাকৃতির হার ছিল প্রায় ৬০%, যা ২০১৯ সালে কমে দাঁড়ায় ২৮%–এ । ওয়েস্টিং বা ওজনের অভাবে ভোগা শিশুদের হারও ২০১৪ সালের প্রায় ১৪% থেকে কমে ২০১৯ সালে ৯.৮%–এ নেমেছে । চরম দারিদ্র্যও হ্রাস পেয়ে ১২.৯% থেকে ১০.৫% (২০১৯) –এ এসেছে । ২০১৪ থেকে ২০১৯–এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কারণে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার কমেছে ৪১.৭% থেকে ২৪.৬% ।
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের “Sustainable Development Solutions Network” (SDSN) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “এসডিজি প্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ড” প্রদান করে । এই সম্মাননা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সরকারের ধারাবাহিক অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা ও শিশু কল্যাণ খাতে দৃশ্যমান উন্নতির জন্য । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এসডিজি রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছিলেন । এটি জাতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বিতভাবে গৃহীত হয় এবং তাঁর অগ্রাধিকার ছিল: ভ্যাকসিনের সর্বজনীন প্রাপ্যতা, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জলবায়ু সহনশীলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ । তিনি এমন এক “সোনার বাংলা”–এর স্বপ্ন দেখেছিলেন—একটি এমন দেশে, যেখানে থাকবে না ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, যা জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং বৈশ্বিক সংঘাতের কারণে বাড়তে থাকা বৈষম্যের প্রতিও দাঁড়াতে পারবে । এই অগ্রাধিকারগুলোই বাংলাদেশের উজ্জ্বল ও টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে । শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ৩৯+১ টি জাতীয় অগ্রাধিকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে একটি ব্যাপক অর্থায়ন কৌশল । এর ফলস্বরূপ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আরও গতিশীল হয়েছে ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ২০১৭ সালের “A World of Three Zeros” (“তিন শূন্যের বিশ্ব”) বইয়ে তিনি একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন—যা ত্রুটিপূর্ণ পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপন করে “পরোপকারী পুঁজিবাদ” বা সোশ্যাল বিজনেস মডেলে কেন্দ্রীভূত । তাঁর "তিন শূন্য তত্ত্ব"-এর তিনটি প্রাথমিক লক্ষ্য রয়েছে: ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে শূন্য দারিদ্র্য, যুবসমাজের মধ্যে উদ্যোক্তা শিক্ষার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি মাধ্যমে শূন্য নেট কার্বন নির্গমন । এক্ষেত্রে তিনি সামাজিক ও পরিবেশগত কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে “নতুন পুঁজিবাদ” বা সামাজিক ব্যবসাকে কাম্য মডেল হিসেবে এগিয়ে আনেন ।
তবে কিছু সমালোচনায় বলা হয়—তিন শূন্য তত্ত্ব পুরোপুরি মৌলিক নয়, বরং তা MDGs (২০০০-২০১৫) এবং SDGs (২০১৬–বর্তমান)–এর লক্ষ্য ও দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত । ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 'তিন শূন্য তত্ত্ব', শূন্য দারিদ্র্য, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ১: দারিদ্র্য হ্রাসের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ । এসডিজি-১, লক্ষ্যটি চরম দারিদ্র্য নির্মূল এবং বৈষম্য হ্রাসের ওপর গুরুত্বারোপ করে । মাইক্রোক্রেডিট ও সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে, ড. ইউনূস দরিদ্রতম জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে । বিশেষ করে নারীদের ও গ্রামীণ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে তাঁর উদ্যোগগুলো দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে মনে করা হলেও এর সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কতটুকু পাচ্ছে সেই ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে । তাঁর মডেলটি স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং আত্মনির্ভরশীলতার ওপর জোর দেয় যা SDG লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অপরিহার্য । এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১: দারিদ্র্য দূরীকরণ একটি বৈশ্বিক সহযোগিতামূলক উদ্যোগ যা ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নির্মূল করার লক্ষ্যে কাজ করছে । এসডিজি-১ লক্ষ্যটি দৈনিক $১.২৫-এর কম আয়ে জীবন যাপনকারী জনগণের চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে । এই উদ্যোগের মূল উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যাতে তারা মৌলিক সেবা ও সহায়তা পায় । পুরুষ ও নারীদের জন্য অর্থনৈতিক সম্পদ, ভূমি মালিকানা, মৌলিক সেবা, প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ, উত্তরাধিকার এবং আর্থিক সেবায় সমান অধিকার নিশ্চিত করা । জলবায়ু সম্পর্কিত দুর্যোগ ও আর্থিক ঝুঁকি থেকে দরিদ্র জনগণের সহনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং দরিদ্র-বান্ধব এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে তাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য সম্পদ সংগ্রহ করা ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের “তিন শূন্য তত্ত্ব” এর দ্বিতীয় স্তম্ভ, "শূন্য বেকারত্ব", টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) ৮: সম্মানজনক কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । এসডিজি-৮ লক্ষ্যটি সম্মানজনক কাজের সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দেয় । ড. ইউনূস ঐতিহ্যগত বেকারত্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, যা মূলত আর্থিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্টি হয় । তিনি যুবসমাজের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাবের বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন । তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি এসডিজি ৮- এর লক্ষ্যগুলির সাথে সম্পর্কিত, যার মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার সুযোগ বৃদ্ধি, সমান বেতন নিশ্চিত করা, বেকারত্ব হ্রাস করা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা । এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৮: সম্মানজনক কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্যোগের লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোতে বার্ষিক ৭% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, যা উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব হবে । এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি, যা সম্মানজনক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং উদ্যোক্তা মনোভাবকে উৎসাহিত করবে, পাশাপাশি সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করবে । এই উদ্যোগের বিশেষ লক্ষ্য হল ২০২০ সালের মধ্যে যুব বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা এবং ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু ও জোরপূর্বক শ্রম সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা, সমস্ত শ্রমিকের জন্য শ্রম অধিকার সুরক্ষিত করা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা । টেকসই পর্যটন নীতি প্রণয়ন করা, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্যের প্রচারে সহায়ক হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২০৩০ সালের মধ্যে আর্থিক সেবা, যেমন ব্যাংকিং, বীমা ও আর্থিক সেবায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি করা এবং ২০২০ সালের মধ্যে একটি বিশ্বব্যাপী যুব কর্মসংস্থান কৌশল প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) গ্লোবাল জবস প্যাক্ট বাস্তবায়ন করা ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ১৩: জলবায়ু কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । এসডিজি-১৩ লক্ষ্যমাত্রাটি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে । ড. ইউনূস জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি, এবং সার্কুলার অর্থনীতি (তিনটি R: Reduce, Reuse, Recycle) তে বিনিয়োগের সমর্থক । ড. ইউনূসের মতে, "শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ" অর্জন করতে হলে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নতি নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনও প্রয়োজন । তিনি এই পরিবর্তনকে একটি নতুন জীবনধারা হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই হবে । এই তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যেমনঃ প্যারিস চুক্তির (Paris Agreement) সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে । এসডিজি-১৩ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর $১০০ বিলিয়ন জলবায়ু অর্থায়ন সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা । বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF) বা সবুজ জলবায়ু তহবিল এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করে । স্বল্পোন্নত দেশ এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে জলবায়ু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে । বিশেষ করে নারী, যুবক ও প্রান্তিক জনগণকে নেতৃত্বে সম্পৃক্ত করতে হবে । এসডিজি ১৩-এর লক্ষ্যসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা ও প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে ।
এছাড়াও, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৭: সাশ্রয়ী ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, নিট শূন্য কার্বন নিঃসরণ অর্জনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত । এসডিজি-৭ লক্ষ্যমাত্রাটি সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই আধুনিক জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, যা আমাদের বিশ্বে এক বিপ্লব ঘটাতে পারে এবং এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং আমাদের পৃথিবীকে একটি নিম্ন-কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তর করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । এসডিজি-৭ এর আওতাভুক্ত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জ্বালানির দক্ষতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিলে, আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারব এবং টেকসই ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারব ।
ড. ইউনূসের "তিন শূন্য", শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এসডিজি-৯ (শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো), এসডিজি-১৪ (জলজ প্রাণের জীবন), এসডিজি-১৬ (শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান) এবং এসডিজি-১৭ (লক্ষ্য অর্জনে অংশীদারিত্ব)-এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত । এসডিজি-৯, কার্বন নির্গমন কমাতে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করতে টেকসই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের উপর জোর দেয় । এসডিজি-১৪, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ ধরার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে । এসডিজি-১৬, এর লক্ষ্য শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং শান্তিপূর্ণ সংঘাত সমাধানকে উৎসাহিত করা, যা সকল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য । এসডিজি-১৭ অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেয় । এছাড়াও, পরোক্ষভাবে তিন শূন্য তত্ত্ব এসডিজি-৪, এর সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উদ্যোক্তামূলক শিক্ষার উদ্যোগকে উৎসাহিত করে মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয় । এছাড়াও, এটি এসডিজি-৫, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে লিঙ্গ সমতার উপর জোর দেয় ।
সার্বিকভাবে, তিন শূন্য তত্ত্বে মৌলিকত্বের অভাব রয়েছে বলেই মনে হয় এবং তিন শূন্য তত্ত্ব এসডিজি এর লক্ষ্যসমূহকে শুধুমাত্র স্পষ্ট ও সহজবোধ্যভাবে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করে কিন্তু তিন শূন্য তত্ত্ব এর কোনো নিজস্ব স্বকীয়তা নাই । ড. ইউনূস বর্তমানে বাংলাদেশের অসাংবিধানিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হলেও দেশের জনগণের কাছে বিতর্কিত রাজনীতিবিদ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । ২০১৭ সালে তিনি "ট্রিপল জিরো" তত্ত্বটি মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) এর নীতিমালার উপর ভিত্তি করে প্রস্তাব করেন এবং এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে "ট্রিপল জিরোস" তত্ত্ব ড. ইউনূসের তৈরি কোনো মৌলিক তত্ত্ব বা ধারণা নয় । আমরা যদি সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ কর্তৃক বর্ণিত SDG এর লক্ষ্যমাত্রাগুলি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই, তাহলে বিশ্বের "ট্রিপল জিরো" তত্ত্ব অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমরা মনে করি না । টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের জন্য ২০৩০ সালের সময়সীমা যত এগিয়ে আসছে, উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ একমত যে, এখন আমাদের মনোযোগ তাত্ত্বিক ধারণাগুলির পুনরাবৃত্তি ও ওভারল্যাপ করার পরিবর্তে এসডিজি বাস্তবায়নের উপর হওয়া উচিত । বিশ্ব সম্প্রদায় ইতিমধ্যেই কী করা দরকার তা এসডিজি এর মাধ্যমে নির্ধারণ করে ফেলেছে; এখন শুধু এই লক্ষ্যমাত্রাগুলি অর্জনের জন্য আমাদের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, আর্থিক সম্পদ এবং সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা প্রয়োজন । দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করা কোনো ঐচ্ছিক নয় বরং টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য । যদিও ড. ইউনূসের তত্ত্ব মহৎ উদ্দেশ্য থেকে উৎসারিত এবং এটি এমন একটি বার্তা তুলে ধরে, যা বিশ্ব ইতিমধ্যে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছে । ওভারল্যাপিং বা পুনরাবৃত্তি দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদ অনুসরণ করার পরিবর্তে, বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) এবং প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নত ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে । লক্ষ্য পূরণের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ, যেমন তথ্য ঘাটতি, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও জলবায়ু ঝুঁকি অবশ্যই আছে । চ্যালেঞ্জ যতই থাকুক, অন্তর্ভুক্তিমূলক অবকাঠামো, জলবায়ু সহনশীলতা এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকার আমাদের উজ্জ্বল ও টেকসই ভবিষ্যতের বিষয়টি দৃঢ় বিশ্বাসই জাগিয়ে তোলে ।
লেখক: ফেলো, ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)