কনটেন্ট ক্রিয়েটর, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
১২ মে ২০২২ ০৪:১৩
ছবি : বিবিসি
শ্রীলঙ্কার
খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকট এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া
রাজাপাকসের গদি একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের
মুখে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের পাশাপাশি পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেও,
যিনি আবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ভাই। রাজনৈতিক
অস্থিরতা ও সহিংসতা দ্বীপ রাষ্ট্রটির
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যুদ্ধকে আরও কঠিন করে
তুলছে। একটা ‘স্বাভাবিক’
রাষ্ট্র কিভাবে আজকের এই অস্থির সময়ে এসে পৌঁছালো, এই লেখায় পাঠকদের জন্য সেটাই তুলে
ধরার চেষ্টা করা হলো-
সংকটের শুরু
যেভাবে
২০১৯ সালের
শেষ দিকে কোভিড-১৯ মহামারিতে যখন শ্রীলংকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হতে থাকে, তার মাস কয়েক
আগে রাজাপাকসে নির্দিষ্ট কিছু খাতে ট্যাক্স কমিয়েছিলেন। ওই সময় একের পর এক আন্তর্জাতিক
ফ্লাইট বন্ধ হতে থাকে এবং লকডাউনে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো দেশ। একদিকে বিদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার রেমিট্যান্স কমতে থাকে, অন্যদিকে
দেশে বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক। এমন অবস্থায় বিদেশি ঋনের কিস্তি পরিশোধ করা
শ্রীলংকা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মূলত উচ্চাভিলাষী কিছু অবকাঠামো প্রকল্প
দেশটির জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও শ্রীলঙ্কা ভারতের মতো প্রতিবেশীদের কাছ থেকে
কিছু সহায়তা পেয়েছে। তবে জ্বালানি সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় খাবার আমদানির জন্য তা যথেষ্ট
ছিল না। এছাড়া গত বছর কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেন
রাজাপাকসে, যা কৃষকদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং তারা আন্দোলনের ডাক দেন। রাজাপাকসের
ওই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটিতে চা ও ধানের ফলনও অনেক কমে যায়।
শ্রীলঙ্কার
অর্থনীতিতে যা ঘটছে
ইউক্রেন-রাশিয়া
যুদ্ধের প্রভাবে যখন জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত
বাড়ছে, ঠিক সেই সময় শ্রীলঙ্কার ৪১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি প্রায় দেউলিয়াই হয়ে গেছে।
শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি একেবারে কমে গেছে এবং
মুদ্রাস্ফীতি বহু বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম এক বছরের
মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়,
মান কমিয়ে দেয় স্থানীয় মুদ্রার এবং ‘অপ্রয়োজনীয়’ পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু
২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিপরীতে ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেশটির অর্থনৈতিক
পুনরুদ্ধারকে অসম্ভব করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে
গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহিন্দা রাজাপাকসের
পদত্যাগ করেন।
যেসব কারণে
রাজপথে মানুষ
শ্রীলঙ্কার
যেসব ভোটার তিন বছর আগে রাজাপাকসেকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন, তারা এখন কঠিন এক বাস্তবতার
মধ্যে জীবনযাপন করছেন। পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকার কারণে গত মার্চ থেকে গৃহস্থালির
পাশাপাশি বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ নেই। সিএনজি স্টেশনগুলোতে মানুষের দীর্ঘ
সারি। দোকানপাটে জিনিসপত্র নেই। যা-ও আছে, তা-ও কিনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দামে। মূলত
এসব কারণে রাজাপাকসের বিরোধীরা তার পদত্যাগের দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজপথে আন্দোলন
চালিয়ে আসছিলেন।
সরকার কিভাবে
সাড়া দিয়েছে?
দেশটির প্রেসিডেন্ট
গত ৬ মে দুই মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে দিয়ে
আইন নিষ্ক্রিয় করা, লোকজনকে আটক ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপক ক্ষমতা পান তিনি। দেশব্যাপী কারফিউও জারি
করা হয়েছিল। স্থানীয় কিছু গণমাধ্যমের খবরে এমনও বলা হয়েছে যে, বিক্ষোভকারীদের দমাতে
রাজধানী কলম্বোয় সেনাবাহিনীকে নামানো হয়েছিল এবং তাদের হাতে কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়।
কিন্তু সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো রাজাপাকসে কেবল সহিংসতার নিন্দা
জানিয়ে দায় সারার চেষ্টা চালান। আর সঙ্কট সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য
সংসদের সব দলকে প্রস্তাব দেন তিনি। বিরোধীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান। সংবিধান সংশোধন বাতিলের
দাবিও তুলেছেন তারা।
সার্বিক
চিত্র
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে
অবস্থিত শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সংঘাতের
সঙ্গে লড়াই করেছে। সিংহলি-অধ্যুষিত সরকার এবং তামিলদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে
প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত হয়। এরপর থেকে ২০১৯ সালের ‘ইস্টার সানডে’র দিনে আত্মঘাতী বোমা
হামলার আগ পর্যন্ত দেশটিতে সহিংসতায় কমে গিয়েছিল। এই বোমা হামলায় কমপক্ষে ২০০
জনের মৃত্যু হয়। ওই হামলার জন্য সরকার একটি স্বল্প পরিচিত ইসলামি গোষ্ঠীকে দায়ী করেছিল।
অর্থনীতির
কী হবে?
সুদের অর্থ
পরিশোধের জন্য ভারতকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ১২ এপ্রিল সরকার কিছু বিদেশি ঋণদাতাকে
নিজেদের দেউলিয়া হওয়ার আভাস দেয় এবং কিছু দাতার কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করে দেয়। অর্থ
মন্ত্রণালয় থেকে এটাও জানানো হয় যে, একটা সহায়তা প্যাকেজ পাওয়ার জন্য তারা আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কিন্তু তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি গত চলতি মাসের শুরুর দিকে (মন্ত্রিসভা
ভেঙে দেওয়ার আগে) পার্লামেন্টে বলেন, শ্রীলঙ্কা যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, তা থেকে
বেরিয়ে আসতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, আইএমএফ যদি সহায়তা দিলেও এর
কার্যক্রম শুরু হতে হতেই ছয় মাস লেগে যাবে।
সূত্র :
ওয়াশিংটন পোস্ট
জেএফ/এএল