মাইকেল জে ব্রাউন, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
১৯ আগস্ট ২০২২ ০৮:৪৯
জেমস ওয়েব নভোবীক্ষণ থেকে পাওয়া SMACS 0723। সূত্র: অন্তর্জাল
বলা হচ্ছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে সবচেয়ে পুরাতন ছায়াপথ দেখেছি আমরা। আসলেই কি তাই? পুরনো আর নতুনের ভেতর সম্পর্কটা কেমন। একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বদলে যেতে পারে গোটা ধারণা। এ নিয়ে অভিনব কিছু তথ্য আর ভাবনা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক, নক্ষত্র গবেষক মাইকেল জে ব্রাউন। দ্য কনভারসেশন থেকে নিবন্ধটি অনুলিখন করেছেন হামিম কামাল।
সম্প্রতি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া প্রথম
ছবিটা দেখেছে বিশ্ব। তাতে যা যা দেখা গেছে তার একটা তালিকা তৈরি করা যাক। ১. দূরের
গ্রহ, তাদের পরিমণ্ডল, ২. জোটবদ্ধ ছায়াপথ, গুচ্ছ গুচ্ছ জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, ৩. অদেখা কৃষ্ণবস্তুর
আকর্ষণে বেঁকে যাওয়া আলো, ৪. তারার আঁতুড়ঘর- ঘন হয়ে ওঠা গ্যাসীয় মহাজাগতিক মেঘ, এইতো।
পত্রপত্রিকায় পড়েছি- জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দেখাচ্ছে
ব্রহ্মাণ্ডের প্রাচীনতম নক্ষত্রমণ্ডলী! যেমনটি আর কখনো দেখেনি মানুষের চোখ।
মানে কী এ কথার? আমি একজন পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
আমার কাজের বলয়ে আছেন যত পুরাতন ছায়াপথ নিহারিকা। সত্যি বলছি, ওদের এই শিরোনামে আমিও
খানিকটা ধন্দে পড়ে গেছি। বলে কী লোকগুলো। প্রাচীনতম। না, এই উপসংহারে আসা এতো সোজা
নয়।
সামনে দেখি,
দেখি পেছন ফিরে
জেমস ওয়েব নভোবীক্ষণের অন্যতম লক্ষ্যটা কী তা জানা
থাকা দরকার। লক্ষ্যটা অদ্ভুত কিন্তু খাঁটি। তা হলো, সময়ের পেছনে ফিরে দেখা, সেই শুরুর
যুগের মহাবিশ্বটা আমার কেমন ছিল। সন্দেহ নেই আমাদের জেমস ওয়েব দূরবীনমহাশয়ের তা দেখানোর
মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। আর সমস্ত নভোবীক্ষণ যন্ত্রের মতো এই জেমসওয়েবকেও বলা যায় এক
ধরনের টাইম মেশিন। সময় ভ্রমণের গাড়ি। এর সিটে বসে সময়ে ভ্রমণ করে আসা যায়।
আলো সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার ভ্রমণ করে আমরা জানি।
তবে যখন চাঁদের দিকে তাকাই, প্রায়ই মনে পড়ে না, আমরা এর এক সেকেণ্ড আগের রূপটা দেখছি।
চাঁদ-পৃথিবীর দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। যেহেতু আমাদের এই সৌরজগতের বাদবাকি
গ্রহগুলো লক্ষ বা কোটি কিলোমিটার দূরে, তাদের দিকে তাকালে আমরা দেখি মিনিট কিংবা ঘণ্টা
খানেক আগের তাদের রূপ। হয়ত ওই ঘণ্টার ভেতর কোনো গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ছবি থেকে
আমরা স্বাভাবিকভাবেই তা জানব না।
এতো গেল লক্ষ
বা কোটি কিলোমিটার দূরের গ্রহের কথা। যখন আমাদের দৃষ্টি আরো দূরে প্রসারিত করি, এমন
সব জ্যোতিষ্কমণ্ডলী আমরা দেখি যাদের কাছ থেকে আসতে স্বয়ং আলোরই লক্ষ বা কোটি বছর লেগেছে।
এর মানে যতক্ষণে আমরা সে-সব ছায়াপথ দেখছি, ততক্ষণে ওরা জীবনের লাখ লাখ বা কোটি কোটি
বছর পার করে ফেলেছে। তখন ওরা আর শিশুটি নেই। অথচ আমরা যাকে দেখছি, সে শিশু! আমি কী
বলতে চাইছি, পাঠককে হয়ত এরইমাঝে একটু হলেও বোঝাতে পেরেছি।
কী দেখেছে
জেমস ওয়েব নভোবীক্ষণ
জেমস ওয়েব অন্য যে কোনো নভোবীক্ষণের চেয়ে বেশি দূরের জ্যোতিষ্ক দেখতে পায়। এমনকি হাবল নভোবীক্ষণ যত দূরে পারে, তারচেয়েও। হাবলের মতোই জেমস ওয়েব নভোবীক্ষণের অবস্থান পৃথিবীর পরিবেশ থেকে বহু ওপরে। মূলত জেমস ওয়েব আরো ওপরে। আরও ব্যাপার আছে। হাবলের প্রতিফলক আয়নাটা যেখানে ২.৩ মিটার, ওয়েবের সেখানে ৬.৫ মিটার, এবং ১৮টা ষড়ভূজাকৃতির খণ্ডাংশ দিয়ে তৈরি। আয়নাগুলো অবলাল রশ্মি ধরার উপযুক্ত করে তৈরি।
কারণ
দূরের ছায়াপথ থেকে আলো আসে তা অবলাল রশ্মি হিসেবেই আসে। কোনো জ্যোতিষ্ক বা ছায়াপথ যদি
অতিবেগুণী রশ্মিও নিঃসরণ করে, দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে আসতে পথে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বেড়ে
তা অবলাল রশ্মিতে পরিণত হয়। আর মহাবিশ্ব তো আয়তনে ক্রমশ বাড়ছেই। বাড়ছে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীগুলোর
দূরত্ব। সব মিলিয়ে শ্রী অবলালমোহন গাঙ্গুলির ওপরই ভরসা।
ওয়েব নভোবীক্ষণ থেকে যেসব অবলাল ছবি আমরা পেয়েছি,
তাদের মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বিখ্যাত, যাকে দেখে আমার অন্দর আলোকিত হয়ে উঠেছে, মন খুশি
হয়ে উঠেছে, সেই ছবির সবচেয়ে উজ্জ্বলতর যে জ্যোতিষ্ক-সমাবেশ, তার নাম SMACS 0723 ।
SMAC 0723 থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে সময়
নিয়ে ৪৬০ কোটি বছর। সুতরাং আমরা তার এমন এক রূপ দেখছি যা আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগের।
আরও ৪ কোটি বছর পর সূর্য জন্ম নেবে, ভাবা যায়? সূর্য-পৃথিবীর বয়স তো ৬৫৬ কোটি বছর।
ওই ছবিতে SMACS 0723'র চেয়েও দূরের জ্যোতিষ্কমণ্ডলী আমাদের নজর কাড়ছে। আশপাশেই ওরা চিহ্নত হয়েছে। অনুমান করা হয়েছে, এ ছবির কাগজে আলো হয়ে ধরা দিতে তারা পাড়ি দিয়ে এসেছে অকল্পনীয় দূরত্ব। হতে পারে সময় লেগেছে ১৩৫০ কোটি বছর! দূরত্বটা বের করতে ৯ লক্ষ কোটির সঙ্গে ১৩৫০ কোটি গুণ করতে হবে।
‘হতে পারে’ শব্দটার ওপর জোর দিচ্ছি আমি। কারণ তাদের
দূরত্ব নিয়ে নিশ্চিত হতে আমার আরো তথ্য-উপাত্ত দরকার। তবে এটুকু নিশ্চিত ওখানে কিছু
জ্যোতিষ্কমণ্ডলী আছে যাদের অতোটা দূরের হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এর মানে ততটা পুরনো
হওয়াও সম্ভব।
যেহেতু ওখান থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে
১৩৫০ কোটি বছর লেগেছে বলছি আমরা, সহজ, আমরা ওদের ১৩৫০ কোটি বছর আগের রূপটাই দেখছি।
সেক্ষেত্রে আমরা কি অনুধাবন করতে পারছি আদৌ, কিসের দিকে তাকিয়ে আছি? অর্থাৎ ওই ছবির
মাত্র ৮০ কোটি বছর আগে বিগব্যাং হয়েছিল! সৃষ্টিরহস্যের সূচনাবিন্দু, সেই মহাবিস্ফোরণ!
নবীন, প্রাচীন
নাকি ঊষালগ্নের
দূরের এ জ্যোতিষ্কমণ্ডলীগুলোকে যেহেতু সবচেয়ে বয়োঃবৃদ্ধ,
সবচেয়ে প্রাচীন জ্যোতিষ্কমণ্ডলী বলা হচ্ছে, এবং আমারও যে বিভ্রান্তি জেগেছে তাকে যেন
পুরনো অ্যালবামে খুঁজে পাওয়া পরদাদার ছোট বেলার ছবির সাথে তুলনা করা যায়। তাকে বুড়ো
বলতে পারিকি আমি? তিনি তো ছবির শিশু। আমরা SMACS 0723’ এর ছবিতে দূরে দূরে আরো যাদের
দেখছি, তারা কেউ প্রাচীনতম, বয়োঃবৃদ্ধতম নয়, বরং একেবারে তরুণ নবীন কাঁচা, আমার বিচারে।
তাদের বয়স হয়ত মাত্র কয়েক কোটি বছর বা এমন।
এটা সত্যি যে ওরা আজ অনেক অনেক পুরনো, বিগব্যাং’র
কাছাকাছি সময়ের মতো। কিন্তু ওদের আজ দেখছি বলেই সবচেয়ে পুরনোকে দেখছি তাই বা বলি কী
করে। আমরা যার ভেতর বাস করছি, তাকেই যেন এড়িয়ে যাচ্ছি অনুচিৎ অবহেলায়। আমাদের আবাসস্থল
প্রিয় আকাশগঙ্গা- মিল্কিওয়ের বয়েস কি কম? মিল্কিওয়েতে এমন অনেক নক্ষত্র আছে যাদের বয়স
হাজার কোটি বছর। এবং আরো কিছু নক্ষত্র আছেন যাদের বয়েস হতে পারে হাজার পেরিয়ে। ১৩০০
কোটি বছর হতেও বাধা নেই।
আরো কিছু মজার ব্যাপার আছে। ছায়াপথ কিভাবে বড় হয়?
গ্যাস, কৃষ্ণবস্তু ঘনীভূত হয়ে তৈরি হলো নতুন তারা, তৈরি হলো তাদের সৌর পরিবার। এভাবে
প্রতিটা ছায়াপথ ক্রমশ বড় হলো। তারপর এক ছায়াপথ আবার আরেক ছায়াপথে মিশে যায়। তৈরি হয়
আরো বড় এক ছায়াপথ। এই যদি হয়, তো কোন ছায়াপথ কত পুরনো বললে সুবিচার হয়, তা তো জানা
নেই।
হয়ত একটা ছোট্ট ছায়াপথ, বিগব্যাঙের মাত্র কয়েক বছর
পর জন্মেছে, আর মুহুর্মুহু তারা ফোটাচ্ছে, সে আমাদের ছবিতে এলো। তো সেই ছায়াপথের আজ
হয়ত এতো বয়েস হয়েছে যে কল্পনায়ও আঁটবে না। আবার সেই ছায়াপথ হয়ত আজ এতো বুড়ো হয়েছে যে
কত কোটি বছর আগে শেষ তারা ফুটিয়েছে, তা নিজেও গেছে ভুলে। তো এমন বুড়ো পেলো আরেক
বুড়িকে। দুয়ে মিলে হয়ে গেল এক তরুণী ছায়াপথ। তার কাছ থেকে আসা আলোয় মনে হলো, ‘নাহ,
এর বয়স আর কতই বা হবে’।
রেকর্ড গড়ে
ভাঙার জন্যে
তো কী বলে আখ্যায়িত করব তোমাদের। শিশু নাকি বুড়ো।
শিশু বললেও পোষায় না, কারণ তোমরা বুড়ো। বুড়ো বললেও সুবিচার হয় না, কারণ ছবির তোমরা
শিশু। এর চেয়ে বলি- ঊষাকালের। হ্যাঁ, তোমরা ঊষাকালের ফুল। সৃষ্টি-নাটকের সেই যে সূচনাদৃশ্য,
তোমরা তার কুশীলব।
জেমস ওয়েব এখনও দেখে চলেছে- এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে
উষাকালের সেইসব কুশীলবদের, এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে ঊষাকালের ছায়াপথ-নীহারিকাদের।
আমি বারবার একটা সতর্ক করা শব্দ ছুড়ছি- ‘এখন পর্যন্ত পাওয়া’।
ওয়েব এর অভিযান সবে তো শুরু। আমাদের এই যে এসব বিশ্লেষণ,
তা কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পাওয়া তথ্যের আলোকে তৈরি। সামনের দিনগুলোয় জেমস ওয়েব যখন
আরো আরো তথ্য পাবে, আজকের ঝাপসা, কাল স্পষ্ট হবে। আজকের স্পষ্ট কাল প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এমনকি আজ যাকে সৃষ্টির ঊষামুহূর্তের বলে মানছি, তাকেও দেখব অন্য আলোয়। হয়ত এ বছরের
মধ্যেই। আমরা তার অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা রোমাঞ্চকর।
/এইচকে